ইউসুফ পিয়াস:
আজ সেই দুঃসহ স্মৃতি বিজড়িত ভয়াল ১৫ নভেম্বর। উপকূলীয় এলাকায় ২০০৭ সালের এই দিনেই আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন সিডর। ১৩ বছর আগের এই দিনে উপকূলের প্রকৃতি ও মানবতাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সুপার সাইক্লোন সিডর। দিনটি উপকূলবাসীর জন্য বেদনার।
আজ উপকূলীয় জেলাগুলোর কয়েক হাজার বাড়িতে সৃষ্টি হবে শোকাবহ পরিবেশ, ঝড়ে এইদিনে আপনজনদের হারিয়ে ফেলেছেন তারা। আরও হাজার হাজার মানুষ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বয়ে বেড়াচ্ছেন এই দিনে পাওয়া আঘাতের ক্ষত। তবে প্রকৃতিতে সিডর যে ছাপ রেখে গেছে তা এখনও মুছে ফেলতে পারেনি মানুষ, কাটিয়ে উঠতে পারেনি সেই ঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতি। বলা যায়, সিডরের পর ১৩ বছরেও স্বাভাবিক হয়নি বরগুনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুরসহ উপকূলবাসীর জীবনযাত্রা।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী সিডরে নিহতের সংখ্যা ৩ হাজার ৪০৬ জন, নিখোঁজ ও মারাত্মক আহত ৫৫ হাজার এবং ১ হাজার ৩ জন এখনো পর্যন্ত নিখোঁজ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিডরের তাণ্ডবে বরগুনার বিভিন্ন নদীতে দেওয়া বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে গিয়েছিল। এখনও সেসব বেড়িবাঁধের অনেকগুলো ভাঙা থাকায় লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে ঢুকে বাড়াচ্ছে লবণাক্ততা। ফলে উপকূলীয় চরাঞ্চলের জমিতে ধান চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ফলে দারিদ্র্যের পাশাপাশি এসব এলাকায় পরিলক্ষিত হচ্ছে সন্ত্রাসী চাঁদাবাজি ও যৌতুক প্রবণতা। মারাত্মকভাবে বাড়ছে শিশুশ্রম।
উপকূলীয় এলাকার ১২ জেলায় সুপার সাইক্লোন সিডর আঘাত হেনেছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও পিরোজপুর জেলা। ঘূর্ণিঝড়টি তাণ্ডব চালিয়েছিল ঝালকাঠি, সাতক্ষীরা, খুলনা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিতপুর, বরিশাল ও ভোলাতেও।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সিডরের আঘাতে বরগুনা জেলায় ১ হাজার ৩৪৫ জন মানুষ মারা গেছেন। নিখোঁজ রয়েছেন আরও ১৫৬ জন। ৩০ হাজার ৪৯৯টি গবাদি পশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯টি হাঁস-মুরগি মারা যায়। জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১টি পরিবারের সবাই কমবেশি ক্ষতির শিকার হন। সম্পূর্ণভাবে গৃহহীন হয়ে পড়ে ৭৭ হাজার ৭৫৪টি পরিবার। তবে বেসরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৬শ’ জনের ওপরে।
আর সরকারি হিসাবে সিডরে বাগেরহাট জেলায় নিহত হয়েছিল ৯০৮ জন, আহত ১১ হাজার ৪২৮ জন। সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় ৬৩ হাজার ৬শ’ বাড়িঘর। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় পাকা ৫ কিলোমিটার সড়ক, কাঁচা সড়ক ধ্বংস হয় প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকার। আর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার বাঁধ। মারা যায় ১৭ হাজার ৪২৩টি গবাদি পশু। বিনষ্ট হয়েছে ১২ হাজার হেক্টর ক্ষেতের ফসল ও ৮ হাজার ৮৮৯ হেক্টর চিংড়ি ঘের।
সিডরে এতো মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ওই সময় আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবাণী যথাযথ ছিল না। আবহাওয়া অফিস ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত থেকে হঠাৎ ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের ঘোষণা দেয়। মোংলা সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে যে সতর্ক সংকেত প্রচার করা হয়েছিল, তা বোঝার উপায় বরগুনার মানুষের ছিল না। রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল প্রায় নিষ্ক্রিয়। দুই এক জায়গায় তারা মাইকিং করলেও বেশির ভাগ জায়গায়ই কোনও সতর্ক সংকেত প্রচার করা হয়নি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তথ্য অফিস মাইকিং করলেও তা ছিল শহর এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। যারাও ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত শুনেছেন, তারাও পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেননি।
বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, উপকূলীয় এলাকায় আরও কমিউনিটি রেডিও স্টেশন স্থাপন করতে হবে। যাতে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ দ্রুত সতর্কবার্তা পেতে পারে। তিনি আরও বলেন, বরগুনাসহ সিডর বিধ্বস্ত উপকূলীয় জনপদে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নে ব্যাপক কাজের নামে বরাদ্দ দেওয়া হলেও তার অধিকাংশ চলে গেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এনজিওদের পকেটে। তাই সিডর বিধ্বস্ত এই জনপদের মানুষের মধ্যে ত্রাণ কিংবা ঋণ বিতরণ করা হলেও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, সিডরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা এতো সহজ নয়। তবে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ উপকূলের জনগণকে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবে বলে আশা তার।
এবিষয়ে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, সিডর বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এর ক্ষতি অপূরণীয়। তবু সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করলে উপকূলবাসী কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।
ওয়াইপি/পাবলিক ভয়েস